খাতনা শুধু ছেলেদের হয় না, খাতনা হয় মেয়েদেরও। শুনেছেন কখনও ? বাল্য অবস্থায় ছেলেদের মতো মেয়েদের যৌনাঙ্গেও চালানো হয় ছুরি, ব্লেড। কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় বিশেষ কয়েকটি অংশ। শুনেছেন কখনও ? একে বলা হয় FGM (Female Genital Mutilation)। তবে সর্বত্র হয় না। পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে মহিলাদের খাতনার রেওয়াজ আছে। হয়তো শুনেছেন। শুনলেও হয়তো সেভাবে গুরুত্ব দেননি বিষয়টিতে। আসলে আজকাল আমাদের আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আমরা ধাতস্থ হয়ে গেছি, 'যা চলছে চলতে দে '-তে । আমরা দেখি, জানি - তারপর নিজের কাজে চলে যাই। ভুলে যাই, যা কিছু ভোলার।
অদ্ভুতভাবে “নারী-স্বাধীনতা” আন্দোলনের অগ্রজ ভূমিকায় যাঁরা, তাঁরাও চুপচাপ। অনেকে তো জানেনই না, এধরনের কিছু আছে বলে। কারোর কারোর ধারণা, এদেশে হয় না। আফ্রিকার দেশগুলিতে হয়। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল – আমাদের দেশেও হয়। তবে আফ্রিকার তুলনায় সংখ্যাটা কম। আমাদের দেশে শুধুমাত্র দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের মহিলাদের খাতনার খবর পাওয়া যায়। তাও ওই সম্প্রদায়ের মহিলারা এখন নিজেরাই রাস্তায় নেমেছেন তাই। সরকারের কোনও হেলদোল নেই। এতকাল পর শেষে গত ডিসেম্বরেই রাষ্ট্রসংঘে চিঠি দিয়ে বোহরা মহিলারা আবেদন জানিয়েছেন যাতে FGM-এর তালিকায় রাষ্ট্রসংঘ ভারতের নাম অন্তর্ভুক্ত করে।
তবে রাষ্ট্রসংঘ নথিভুক্ত করেই বা কী করবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সহ নানা মানবাধিকার সংগঠন, স্বাস্থ্য সংস্থার অনুরোধ, নির্দেশিকায় কাজ হয় না কিছুই। আজও এই নৃশংস প্রথার শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয় কত কিশোরীকে, জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে কতশত মহিলার। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই নৃশংস প্রথা ও মহিলাদের এই কষ্ট থেকে লাঘব করতে বৈশ্বিক উদ্যোগ নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন।
FGM একনজরে
কী এই ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন
মহিলাদের যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশ ছেদ করার প্রক্রিয়াকেই সাধারণভাবে ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন বলা হয়। জন্ম থেকে ১৫ বছর বয়স- ছেদ করা হয় এমন মেয়েদেরই যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশ। যিনি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাঁর কোনও প্রশিক্ষণ থাকে না। অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের মতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন মহিলা এই কাজটি করে থাকেন। অর্থাৎ কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই অল্পবয়সী মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছেদ করেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে জানলে গা শিউরে উঠবে। প্রক্রিয়া চলাকালীন শিশু-কিশোরীদের বেশিরভাগ সময়ই অজ্ঞান করা হয় না। অর্থাৎ সজ্ঞানে এই নিদারুণ কষ্টকর প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করানো হয়। শিশু-কিশোরীর হাত-পা-মুখ চেপে ধরার ব্যবস্থাও করা হয় যৌনাঙ্গ ছেদের সময়ে।
কখনও ছুরি, কখনও কাঁচি, ব্লেড বা কাচের টুকরো দিয়েও মেয়েদের স্পর্শকাতর ওই অংশটির নানা অংশ কেটে ফেলা হয়।
FGM-এর সাধারণভাবে চারটি প্রকার রয়েছে। অর্থাৎ চারটি প্রক্রিয়ায় মেয়েদের যৌনাঙ্গের নানা অংশে ছেদ করানো হয়।
- ক্লিটোরিডেক্টমি : সম্পূর্ণ ক্লিটোরিস কেটে বাদ দেওয়া হয়।
- এক্সসিজ়ন : সম্পূর্ণ ক্লিটোরিস বা কিছু অংশ কেটে বাদ দেওয়া হয়। কেটে বাদ দেওয়া হয় ইনার ল্যাবিয়া ।
- ইনফিবুলেশন : ল্যাবিয়াকে কেটে, সিল করে যৌনপথকে সরু করার প্রক্রিয়া।
- অন্য পদ্ধতি : কোনও কোনও ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশ নৃশংসভাবে কাটা, ফুটো করা, বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
ক্ষতি
সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর এই পদ্ধতিটি যে সব মেয়েদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাঁদের জীবন। স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা বলছেন মহিলাদের যৌনাঙ্গে ছেদের ফলে কোনও উপকার হয় না, বরং মহিলাদের শরীরে এর তীব্র বিরূপ প্রভাব পড়ে।যৌনাঙ্গে ছেদের ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে তার উপর নজর রাখা যাক।
- অসহ্য যন্ত্রণা
- আঘাত (শারীরিক ও মানসিক)
- রক্তপাত
- যৌনাঙ্গে মারণ সংক্রমণ, টিটেনাস, গ্যাংগ্রিন
- HIV, হেপাটাইটিস B, হেপাটাইটিস C সংক্রমণের সম্ভাবনা
- মূত্রত্যাগের ক্ষমতা খর্ব হওয়া
- যৌনাঙ্গ ও যৌনপথ লাগোয়া টিসুর সমূহ ক্ষতি
- যৌনাঙ্গ লাগোয়া অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মূত্রনালি, জরায়ুর সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা
- পিরিয়ড অস্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা
- মূত্রত্যাগে সমস্যা
- কিডনির সমস্যা, খারাপ হয়ে যেতে পারে কিডনি
- জনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে
- আসতে পারে বন্ধ্যাত্ব
- যৌনমিলনের সময় যন্ত্রণাভোগের সম্ভাবনা
- মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, বাড়তে পারে উদ্বেগ, খিটখিটে স্বভাব
- হতে পারে মৃত্যুও
কোথায় কোথায় হয়
প্রক্রিয়াটি অবশ্য বহু পুরনো। কোথা থেকে এই পদ্ধতির উৎপত্তি তা স্পষ্ট না হলেও ইজিপ্টের অনেক মমিতে যৌনাঙ্গে ছেদের প্রমাণ মেলে বলে দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায় । আর তা সত্যি হলে এটা পরিষ্কার, পদ্ধতিটি বেশ পুরনো।
এখন আফ্রিকার প্রায় ২৭টি দেশে মহিলাদের এই পদ্ধতিটির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেন, ইরাকের কুর্দিস্তানেও যৌনাঙ্গে ছেদ করানো হয় মহিলাদের। এছাড়াও এশিয়ার পিছিয়ে পড়া কিছু এলাকা, মধ্যপ্রাচ্যেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ এখনও আছে। বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায় জিবৌতি, এরিত্রিয়া, সোমালিয়া এবং উত্তর সুদানে আকছার এই পদ্ধতির শিকার হতে হয় নাবালিকাদের। রাষ্ট্রসংঘের পপুলেশন ফান্ড বলছে, ২০১৬ পর্যন্ত ৩০টি দেশে প্রায় ২০ কোটি নাবালিকা যৌনাঙ্গ ছেদের শিকার হয়েছে।
UNFPA-র তথ্য বলছে, নির্দিষ্ট কিছু জাতির মধ্যে এখনও যৌনাঙ্গ ছেদের প্রক্রিয়া বিদ্যমান। নিচে দেওয়া হল তেমনই কয়েকটি দেশের নাম-
তথ্য বলছে, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় কিছু জাতির মধ্যে এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইয়েমেন, ইরাক , প্যালেস্তাইন ও ইজ়রায়েলে নাবালিকাদের যৌনাঙ্গে ছেদ ঘটানো হয়।
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় কলম্বিয়া, ইকুয়েডর ও পেরুতে FGM এখনও করানো হয়।
এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, ইউরোপ, অ্যামেরিকা, ব্রিটেনে বসবাসকারী কিছু প্রবাসী নাবালিকার যৌনাঙ্গে ছেদ করিয়ে থাকে।
কেন ?
মূলত লিঙ্গবৈষম্যই এর অন্যতম কারণ। কিছু জায়গায় ধর্মীয় কারণে যৌনাঙ্গ ছেদ করা হয়। কোনও কোনও জাতির বিশ্বাস, যৌনাঙ্গ ছেদ করালে মহিলাদের যৌনতায় রাশ টানা সম্ভব। শুধু তাই নয়, কুসংস্কারের কারণেও মহিলাদের যৌনাঙ্গের অন্যতম অংশগুলিকে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বের কোনও কোনও অংশে অন্ধবিশ্বাস, যৌনাঙ্গে ছেদ করালে মেয়েদের সতিত্ব বজায় থাকে। তাই অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে বাড়ির ছোট্ট শিশুটিকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতেও পিছপা হয় না তারা।FGM রোধে উদ্যোগ
ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন রোধে নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কখনও সরকারি উদ্যোগে, কখনও বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে। লন্ডন সহ বিভিন্ন দেশে এই প্রক্রিয়া আইনত নিষিদ্ধ, কিন্তু, তা কার্যকর করতে তেমন উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ। ১৯৪৮ সাল থেকে এই নৃশংস প্রক্রিয়া বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা FGM-কে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং এটি বন্ধ করতে সর্বস্তরে উদ্যোগ বাড়াতে বলে।শুধু তাই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৭ সালে UNICEF ও UNFPA-র সঙ্গে যৌথভাবে FGM বিরোধী বিবৃতি দেয় WHO। ১৯৯৭ সাল থেকেই অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে FGM-কে রোখার চেষ্টা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক স্তরে নজরদারি চালানোর জন্য গঠিত হয় বিশেষ কমিটি। যৌনাঙ্গে ছেদের প্রক্রিয়া রোধে সংশ্লিষ্ট আইন কাঠামো সংস্কারের কাজ খতিয়ে দেখা হয়। রাজনৈতিক ভাবেও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা হয় ওই উদ্যোগে।
এর ফলে বিভিন্ন দেশে পুরুষ ও মহিলারা FGM-এর বিরোধিতায় আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। তার সুফলও মেলে। গবেষণা মোতাবেক, FGM-এর প্রক্রিয়ায় যাঁরা এখনও যুক্ত, তাঁরা যদি এটিকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে অতি দ্রুত এই অভিশাপকে সমাজ থেকে নির্মূল করা সম্ভব।
২০০৭
২০০৭ সালে UNFPA এবং UNICEF যৌথভাবে FGM-এর বিরোধিতায় কাজ শুরু করে।২০০৮
২০০৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের নটি অন্য সহযোগী সদস্যকে নিয়ে FGM-কে নির্মূল করার লক্ষ্যে বিবৃতি জারি করে WHO। নাম দেওয়া হয়, “Eliminating female genital mutilation: an interagency statement”।২০১০
২০১০ সালে অন্য কিছু আন্তর্জাতিক এজেন্সি এবং রাষ্ট্রসংঘের এজেন্সির সঙ্গে একযোগে “ Global strategy to stop health care providers from performing female genital mutilation" প্রকাশ করে WHO।২০১২
২০১২ সালের ডিসেম্বরে নারী যৌনাঙ্গে ছেদ নির্মূল করতে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।৩০ টি দেশে FGM রোধী আন্দোলনের প্রসার নিয়ে একটি নতুন রিপোর্ট তৈরি করে UNICEF। ২০১৩ সালের রিপোর্টকে সামনে রেখে ২০১৬ সালে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
যৌনাঙ্গে ছেদ করা হয়েছে এমন মহিলাদের দেখভাল যাঁরা করেছেন, এমন স্বাস্থ্যকর্মী ও আধিকারিকদের সমর্থন করতে গতবছরে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে WHO।
এর পাশাপাশি, FGM করা হয়েছে এমন মহিলাদের ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় সচেতনতা বাড়াতেও একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে FGM রোধে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অ্যাসেম্বলি WHA61.16 শীর্ষক একটি রেজ়লিউশন পাশ করে। যাতে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক, মহিলা বিষয়ক বিষয়গুলিতে নির্দিষ্ট কার্যকরী পদক্ষেপের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরও কিছু উদ্যোগ : শুধু WHO-ই নয়, মহিলাদের যৌনাঙ্গে ছেদ রোধে বিভিন্ন সময়ে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংগঠন। উদ্যোগ নিয়েছেন কিছু ব্যক্তি। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বেশকিছু রেজ়লিউশন, FGM বিরোধী আন্দোলনের অভিমুখ স্থির করতে বিভিন্ন দেশ নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করেছে। তাতে করে ইদানিং ওই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ কিছুটা কম হলেও, পুরোপুরি নির্মূল এখনও হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে।
চেষ্টা চালাতেই হবে। একটার পর একটা আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসবে, আর অন্ধকার কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে থাকা কিছু মানুষের জন্য সারাজীবনের মতো শারীরিক-মানসিক সমস্যায় ভুগবে কিছু শিশু-কিশোরী, তা হতে পারে না। তাই আন্তর্জাতিক মহলে চেষ্টা চলবে মানুষকে সচেতন করার। নারীকে সচেতন করার। যৌনাঙ্গ ছেদে কোনও সুফল নেই, যেটুকু আছে তা শুধুই ক্ষতি- এ সার সত্য সমাজে যেদিন সার্বিকভাবে গৃহীত হবে, বোধহয় সেদিনই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন হবে সার্থক।
0 comments:
Post a Comment